পানিপথ ও তিনটি যুদ্ধের গল্প
পানিপথ। উত্তর-পশ্চিম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের
পানিপথ জেলার একটি শহর। এখানে ভারত
উপমহাদেশের ইতিহাসে পানিপথের যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত
ঐতিহাসিক তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল ১৫২৬, দ্বিতীয়টি ১৫৫৬ ও
তৃতীয়টি ১৭৬১ সালে। পানিপথের এই তিনটি যুদ্ধ
নিয়ে লিখেছেন নাজমুল হক ইমন
পানিপথ জেলা সীমানার চারপাশে কার্নাল, সোনিপাত,
জিন্দ, কাইথাল এবং উত্তর প্রদেশ রাজ্য দিয়ে ঘেরা।
বর্তমানে এটি একটি শিল্পনগরী এবং তাঁতশিল্পের
জন্য বিখ্যাত। এখানে পশম বোনা ও তুলার
জিনিংয়ের বড় কারখানা আছে। এখানে দিল্লির
লোদি বংশীয় সর্বশেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদির
কবর আছে। এখানে একটি রেলওয়ে জংশন অবস্থিত।
শহরটি পশম, খাদ্যশস্য ও তুলার একটি বাণিজ্যিক
কেন্দ্র। পানিপথ একটি প্রাচীন শহর। মহাভারতে এর
উল্লেখ আছে; সেখানে পানিপথে সংঘটিত যেসব ঘটনার
বিবরণ দেয়া আছে, ধারণা করা হয় সেগুলো খ্রিস্টপূর্ব
দশম অব্দে ঘটেছিল। পরবর্তীতে পানিপথ
তিনটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের ক্ষেত্র
হিসেবে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকে। প্রথম যুদ্ধে মুঘল
নেতা বাবর ১৫২৬ সালে দিল্লির আফগান সুলতান
ইব্রাহিম লোদির সৈন্যদের পরাজিত
করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করেন।
পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে ১৫৫৬ সালে বাবরের
পৌত্র আকবর বাবরের
উত্তরাধিকারীকে সিংহাসনচ্যুতকারী আফগান
রাজবংশের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন এবং মুঘল
সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তৃতীয় যুদ্ধে ১৭৬১
সালে কান্দাহারের আফগান রাজা আহমদ শাহ মারাঠা ও
শিখদের পরাজিত করেন এবং ভারতে মারাঠা-শাসিত
রাজ্যের পতন ঘটান।
প্রথম পানিপথের যুদ্ধ
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে মুঘল সম্রাট জহিরউদ্দিন
বাবর দিল্লির আফগান সুলতান ইব্রাহিম
লোদিকে পরাস্ত করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করেন। অবসান ঘটান ভারতে লোদিবংশের
শাসনকালের। দিনটি ছিল ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল।
পানিপথ ইতিহাসখ্যাত এক যুদ্ধস্থান। মুঘল
সাম্রাজ্যের উত্থানের পেছনে এই স্থানের
ভূমিকা অবিসংবাদিত। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পথ প্রশস্ত হয়। উত্তর
ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের বর্তমানের
একটি জেলা শহর পানিপথ। ভারতের
রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে ৯০ কিলোমিটার আর
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের পাঞ্জাব রাজ্যের
রাজধানী চন্ডিগড় থেকে ১৬৯ কিলোমিটার দূরে এর
অবস্থান। বর্তমানে পানিপথ প্রসিদ্ধ ভারতের
বয়নশিল্প শহর হিসেবে। ভগবত গীতায়ও পানিপথের
উল্লেখ আছে ‘ধর্মক্ষেত্র’ নামে।
আফগান ও তুর্কি শাসকরা দিল্লির শাসনক্ষমতা দখল
করার জন্য পানিপথকে বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্র
হিসেবে। মুঘল সম্রাট জহিরউদ্দিন বাবর দিল্লির
আফগান সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত
করে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। অবসান
ঘটান ভারতে লোদিবংশের শাসনকাল। দিনটি ছিল
১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিল। লোদিবংশের শাসন সূচিত
হয়েছিল বাহালুল লোদির হাতে।
দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ
মুঘল সাম্রাজ্য ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল
নিয়ে বিস্তৃত ছিল; অঞ্চলটি সে সময় হিন্দুস্থান
বা হিন্দ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়া আফগানিস্তান ও
বেলুচিস্তানের বেশকিছু এলাকাও মুঘল সাম্রাজ্যের
অধীনে ছিল। মুঘল সাম্রাজ্য ১৫২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত
হয়, ১৭০৭ সাল পর্যন্ত এর সীমানা বিস্তার
করে এবং ১৮৫৭ সালের এর পতন ঘটে। চেঙ্গিস খান
ও তৈমুর লঙের উত্তরসূরী জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবর
১৫২৬ সালে দিল্লির লোদিবংশীয় সর্বশেষ সুলতান
ইব্রাহিম লোদিকে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত
করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুঘল
সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের
প্রাক্কালে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হয়ে তখনকার
বার্মার রেঙ্গুনে নির্বাসনে চলে যান। সেখানেই তার
মৃত্যু ঘটে। তবে মূলত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের
মৃত্যুর পরেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়
এবং ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের প্রভাব
প্রতিপত্তি বেড়ে যায়। পানিপথের দ্বিতীয়
যুদ্ধে শেরশাহের উত্তরাধিকারী আদিল শাহের
সেনাপতি হিমু হুমায়ুনপুত্র আকবর ও তার
সেনাপতি বৈরাম খানের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন।
এরপর আকবরের শাসনকালে মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ও
মধ্যভারতে বিস্তৃত হয়। ১৫৬০ সালে বৈরাম
খানকে সরিয়ে আকবর নিজে সকল ক্ষমতা দখল
করেন। আকবর রাজপুত্রদের
সঙ্গে মিত্রতানীতি নেন। মান
সিংহকে সেনাপতি হিসেবে বরণ করেন। কিন্তু মেবারের
শাসক প্রতাপসিংহকে মিত্র করতে সফল হননি।
তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ
মারাঠা সাম্রাজ্য একটি ঐতিহাসিক সাম্রাজ্য।
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর
প্রথমভাগ পর্যন্ত (১৬৭৪-১৮১৮) ভারতবর্ষের
দক্ষিণ পশ্চিমাংশে স্থায়ী ছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন
ছত্রপতি শিবাজী। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের
মৃত্যুর পর মারাঠা সাম্রাজ্য পেশোয়ারের
অধীনে বিস্তৃত হয়। ১৭৬১ সালে মারাঠারা পানিপথের
তৃতীয় যুদ্ধে পরাজিত হয় যা তাদের সাম্রাজ্যের
বিস্তার রোধ করে। পরবর্তীতে মারাঠা সাম্রাজ্য
টুকরো হয়ে কতগুলো রাজ্যে বিভক্ত হয়
এবং ১৮১৮ সালের মধ্যে তারা ইঙ্গ-
মারাঠা যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে একে একে পরাজয়
স্বীকার করে।
সাম্রাজ্যের একটি বৃহৎ অংশ ছিল সমুদ্রবেষ্টিত
এবং কানোজি আংরের মতো দক্ষ সেনাপতির
অধীনস্থ শক্তিশালী নৌ-বাহিনী দিয়ে সুরক্ষিত।
তিনি প্রতিপক্ষের, বিশেষ করে পর্তুগিজ ও
ব্রিটিশদের নৌ-আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গেই প্রতিহত
করেন। সুরক্ষিত
সমুদ্রসীমা এবং শক্তিশালী দুর্গব্যবস্থা মারাঠাদের
সামরিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।"
সূত্রঃ কালেরকন্ঠ
No comments:
Post a Comment